সকাল সাড়ে ছ’টা থেকে আটটা এইসময়টুকু যে কিভাবে কেটে যায় লাবনী বুঝতে পারেনা।রাতে সে অনেক কাজ গুছিয়ে রাখে তারপরেও দেখা যায় সকালবেলায় হুড়োহুড়ি পরে যায়।সকালে ছেলেমেয়েকে ঘুম থেকে তুলে দেয়া,নাস্তা রেডি করা,টিফিন গুছানো সবই নিজহাতে করতে লাবনীর ভাল লাগে।সকালবেলায় ছেলে মেয়েরা কিছু খেতে চায়না।তারপরেও লাবনী টেবিলে নাস্তা সাজিয়ে দেয়।আজও সেই অবস্থা,তারাতাড়ি করে রুটি ভাজছে লাবনী ছেলে রয়ন এসে মায়ের হাতে শার্ট ধরিয়ে দিয়ে বলল,মা একটু আয়রন করে দাওনা! রাতে বললি না কেন করে রাখতাম,চুলায় রুটি কিভাবে যাই আমি?রয়ন বলল, মা আমি কিন্ত খাবোনা আমার জন্য কিছু করোনা,মেয়ে রায়না এসে দাঁড়াল রান্নাঘরের দরজায়,মা প্রত্যেকদিন একই নাস্তা টিফিন আমি কিন্ত খাবনা।রয়ন ফোঁড়ন কাটলো,এ্যা খাসনা নিজের মনের মত করে বানিয়ে খা,লেগে গেল সকালবেলা দুই ভাইবোনের মধ্যে ঝগড়া।লাবনীর হাতের কাজ শেষ সে চলে গেল ছেলের জামা আয়রন করতে।এরপরে ডাক পরবে অন্দরমহলে,লাবনী তা জানে রয়নের বাবা এই ডাকলো বলে।গোসল করে বেরিয়েই বলবে ‘কই গেলে কই?তোমাদের দিয়ে কিচ্ছু হবেনা।আমার ঘড়িটা তো রাতে এখানেই রেখেছিলাম কোথায় সরিয়ে রেখেছো?জুতাটা মুছে দাও’। সারাদিনের কাজকর্মে এতোটা ধকল সইতে হয়না লাবনীকে।এরপর ছেলেমেয়ে বেড়িয়ে যায় স্কুলের পথে ওদের বাবা বের হয় অফিসের পথে।এবার লাবনীর একার রাজত্ব,বুয়া চলে এসেছে সে তার কাজে ব্যাস্ত হয়ে পরলো।লাবনী ঘর গুছিয়ে এককাপ চা নিয়ে চলে যায় তার প্রিয় বারান্দায়,সব গাছগুলোর দিকে চোখ বুলিয়ে গেলো,টাইম ফুলের কলিগুলো ফুটি ফুটি করছে,ছোটবেলায় বাবার সাথে লাবনী গাছে পানি দিত।লাবনীর হাতে দিয়েই বাবা অনেক গাছ পুঁতে দিতেন আর বলতেন,এই গাছের প্রথম ফুলটা কিন্ত আমার!অমনি লাবনী বলে উঠত,না না আমার।বাবা জোরে হেসে উঠতো।সেই হাসি লাবনীর কানে এখনো বাজে।ফোন বাজছে লাবনী দৌড়ে গিয়ে ফোন ধরলো,ওপাশ থেকে লাবনীর ছোট ননদ কথা বলে উঠল।হ্যালো ভাবী কেমন আছ?ভালো, তোমরা কেমন আছ?হ্যাঁ ভালো,কি রান্না করছো আজ,তেমন কিছুনা।তেমন কিছুনা মানে?এবার কি আমাদের দাওয়াত দিবানা!কেন বলোতো!কিসের দাওয়াত,স্বর্ণা ভেঙ্গে বলতো।কেনো ভাবী তুমি কি ভুলে গেছো আজ তোমাদের ম্যারেজ এনিভারসারী।লাবনীর এবার খেয়াল হল,আজ কত তারিখ স্বর্ণা?ওহ মাই গড! আমিতো ভুলেই গেছি!একথা বললে কাজ হবেনা ভাবী,আমরা বিকেলে আসছি।আরও কিছুক্ষণ কথা বলার পরে লাবনী ফোন রাখলো।লাবনী খুবই অবাক হল এই ব্যাপারটা সে কিভাবে ভুলে গেলো!রয়নের বাবার কথা না হয় বাদ,সে তো কখনোই এসব মনে রাখার মধ্যে ছিলোনা।কিন্ত সে নিজে কিভাবে ভুলে গেলো!বয়সটা মনে হয় বাড়ছে,কত হল বিয়ের বয়স,বিশ বছরতো হয়েই গেলো।একটা অচেনা অজানা লোকেরসাথে বিশটি বছর কাটিয়ে কতটা তাকে চিনতে বা জানতে পারলো লাবনী!জীবনের বড় প্রাপ্তি “মা”হওয়া লাবনী সেটাই শুধু অর্জন করেছে।স্বামী হিসেবে মাইনুল খারাপ নয়,লাবনী যখন কলেজে পড়তো তখন তার ইচ্ছে ছিল সিনেমার নায়কদের মত কাউকে বিয়ে করবে,যে কিনা যখন তখন পিছন থেকে এসে জড়িয়ে ধরবে আর বলবে,ভালোবাসি তোমায়।লাবনী মনে মনে হাসছে,সারাদিন বলেও কি ভালবাসা বোঝানো যায়!মুখে না বলেও ভালবাসা বোঝানো যায়। লাবনীর যখন মাইনুলের সাথে বিয়ে ঠিক হল ওর মত ছিলনা।বাবা প্রায় জোর করে বিয়েটা দিয়েছিল,শ্বশুরবাড়িতে ঝামেলা করার মত কেউ ছিলনা তাই লাবনী ধীরে ধীরে নিজের মত গুছিয়েনিয়েছিল আর মাইনুলের সাথে অভ্যস্ত হয়েগিয়েছিল।এই মুহূর্তে লাবনীর মনে হচ্ছে,এতোটা সময় কীভাবে কেটে গেল!বিশ বছর কম সময়তো নয়,সময় কি খুব তাড়াতাড়ি চলে গেল!কি করে দিনগুলি সে পার করলো?ছেলেমেয়ে বড় করতে করতে,মাইনুলের ফাই ফরমাস খাটতে গিয়ে,রান্না ঘর ঘুছানো,মেহমানদারি এটাই কি জীবন!বাবা মা বলবে,হ্যা এটাই মেয়েদের জীবন।বিয়ের পরে বাবার উপর অভিমান করে পড়াশুনাটা আর করলোনা।এখন খুব অনুতপ্ত লাবনী।আশেপাশে যখন দেখে অনেক মেয়েরাই চাকরী করছে।বড় বড় ডিগ্রি করতে দেশের বাইরে যাচ্ছে।মনে মনে কষ্ট পায়,নিজের ক্ষতি সে নিজেই করেছে।কি যে ছেলেমানুষ ছিল লাবনী!অকারনে লাবনী অনেক জেদ করতো।মা খুব বকতো বলতো,মেয়েদের এতো জেদ ভালো নয় দুঃখ হয় বেশি,লাবনীর জীবনে দুঃখ তেমন পেতে হয়নি তবে এই একটা দুঃখই তাকে জীবনের এতোটা সময় কুঁড়ে কুঁড়ে খেয়েছে।মাঝে মাঝে নিজেকে অনেক ছোট মনে হয়।লাবনীর নিজের ভাইবোনরা ওর থেকে এগিয়ে আছে ।মনের কোন এক কোনে সামান্য হলেও ঈর্ষা কাজ করে তাই লাবনী ওদের এড়িয়ে চলে,প্রথমদিকে বাবার উপর অভিমান হত,ভাবতো,ইচ্ছে করে বাবা বোনদের ভালো ভালো জায়গায় বিয়ে দিয়েছে,ভাইদের পড়াশুনা করিয়েছে আর ওকে ওদের চেয়ে খারাপ জায়গায় বিয়ে দিয়েছে শুধুমাত্র লাবনীকে শাস্তি দেবে বলে,আজ আর সেই অভিমান নেই ।বাবাও নেই এই জগতে ।মা বেঁচে আছে বাবার স্মৃতি বুকে নিয়ে ।মাঝে মাঝে মাকে দেখতে যায় লাবনী।ওকে দেখলে মা দীর্ঘশ্বাস ফেলে,মা জানে মাইনুলের সাথে লাবনীর সম্পর্কটা তিক্তার।মাইনুল অনেক কথা শোনায় লাবনীকে,আমি বলে তোমার মত অশিক্ষিত বউ নিয়ে সংসার করে গেলাম,আমার কলিগের বউয়েরা অমুক,আমার মত লোক বলে কিছু বললাম না অন্যকেউ হলে আর একটা বিয়ে করতো,তোমার বাপের বাড়ীর লোকজন তো তোমারে আমার ঘাড়ে দিয়া বাঁচছে।কেউতো কোন খোঁজখবরও নেয়না।লাবনী মুখ বুজে শোনে।গায়ে খুব লাগে তারপরেও মুখ বুজে থাকে।আগে খুব তর্ক করতো প্রচণ্ড ঝগড়া হত,হাতাহাতি পর্যায় চলে যেত।খাওয়া,কথা সব বন্ধ থাকতো।আবার লাবনীকে আগ বাড়িয়ে কথা বলতে হত। সংসারকরতেহবে,তাছাড়াযাবেইবাকোথায়!এখানেইথাকতেহবে।তাইলাবনীকেইসবসময়কম্প্রমাইজকরতেহয়।মাইনুলওসেটাবুঝেগেছে,মানঅভিমানেরক্ষেত্রেলাবনীকেসেপাত্তাইদেয়না।এগুলোএখনলাবনীরগাসওয়াহয়েগেছে,এনিয়েএখনআরমনেদুঃখপুষেরাখেনা।এখনছেলেমেয়েকেনিয়েভাবে।রায়নাকেনিজেরপায়েদাড়াতেহবে,মায়েরমতজীবনযেনসেনাপায়।তাকেবুঝতেহবেমেয়েদেরনিজেদেরসন্মাননিজেদেরইঅর্জনকরতেহবে।এবারলাবনীকেউঠতেহবে,বাজারেযেতেহবে,রান্না করতে হবে।বিকেলে ওরা আসবে।ছেলেমেয়েরাও বোধহয় জানে ব্যাপারটা।মাকে সারপ্রাইজ দেবে বলে হয়ত সকালে বলেনি ওরা।লাবনী কাজের মাঝে ডুবে গেলো।
সারাদিন আজ অনেককাজ করেছে লাবনী।রান্না মেহমান দারী সবই একা হাতে এরপরে খাওয়াদাওয়া হয়ে গেলে মেহমানরা সবাই চলে গেলো,ছেলেমেয়েরা শুয়ে পড়েছে।যখন লাবনী শুতে গেলো তখন রাত দেড়টা।মাইনুল গভীরঘুমে আচ্ছন্ন।লাবনী আসা করেছিল আজ মাইনুল তার জন্য জেগে থাকবে।মনের কোনে ছোট্ট একটা অভিমান খোঁচা মেরে উঠলো।কিন্ত না,অভিমান করেতো কোন লাভ নেই!এখন ঘুমিয়ে পরতে হবে আবার সকালে উঠতে হবে,আর একটি নতুনদিন শুরু করতে হবে,সেই দৈনন্দিন কাজ,দিনের শেষে মন খারাপ করা।ছেলেমেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে নিজের সুখ খুঁজে পাওয়া।এটাই হয়ত জীবন।ঘরে ঘরে কি লাবনীর মত মেয়েরা আছে নাকি লাবনী একাই এমন!এতোটা বছর সংসারজীবনে লাবনী নিজের জায়গাটা যাচাই করে কাজেরলোকের সাথে কোন ফারাক খুজে পেলোনা।নিজের জন্য কখনো এটা ভাবতে সাহস পায়নি যে,আজ আমি সারাদিন বাইরে কাটাবো।ঘুরবো বেড়াবো আনন্দ করবো’বরং এটা ভয় পেয়েছে,এমন করলে মাইনুল হয়ত এক কথায় বলবে,চলে যাও”,মাইনুল কোনদিনও লাবনীর শখ বা প্রিয়জিনিসের খোঁজ নেয়নি,কখনো বলেনি,চলো কোথাও বেড়িয়ে আসি’।লাবনীর ভাইবোনরা বছরে একবার বেড়াতে বের হয়,লাবনীকে প্রত্যকবার বলে কিন্ত মাইনুলকে বলতে সাহস হয়না।তাছাড়া প্রথম থেকে লাবনী ওদের সাথে দুরত্ব বজায় রেখেছে তাই আর হয়ে ওঠেনি।রয়ন রায়না যখন বড় হবে তখন না হয় ওদের সাথে বেড়াবে লাবনী।তখনো কি হবে বেড়ানো!লাবনী মনে মনে হাসছে,ভাবছে একদিন কাউকে কিছুনা বলে উধাও হয়ে যাবে,দেখতে ইচ্ছে হয় সবাই কি করে!কিযে হবে লাবনী তাও জানে,মাইনুল খুবই বিরক্ত হবে,রাগ করবে।ছেলেমেয়েরা কাঁদবে,এরপর সবাই একসময় ভুলে যাবে।এটাই লাবনীদের গল্প।